Breaking News

কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত ও কুরবানির গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা

জিলহজ মাসে মুসলমানদের উপর কুরবানির বিধান আসে এবং মুসলিম উম্মাহগণ অনেক অনন্দতার সাথে তা আদায় করে থাকেন। কিন্তু অনেকেই কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন না।

অনেকের ওপর কুরবানি আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু না জানার কারণে সেটি আদায় করতে পারেন না। আবার অনেকে আদায় করলেও সঠিক নিয়ম না জানার কারণে সঠিকভাবে আদায় হয় না।

তাই আজকের আর্টিকেলে আমরা কুরবানির পরিচয়, কাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব, কাদের উপর ওয়াজিব নয় এবং কুরবানির মাসআলা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবো। উপরোল্লিখিত বিষয়াবলি সম্পর্কে জানতে আজকের আর্টিকেলে আপনাকে স্বাগতম!

কুরবানির পরিচয়ঃ-

কুরবানি শব্দটি হিব্রু ভাষা আর আরবিতে قرب বা قربان এবং উর্দূ ও ফার্সীতে (قربانى) কুরবানি নামে পরিচিত। এর আভিধানিক অর্থ হলো “কারো নিকটবর্তী হওয়া।’’

পরিভাষায়, কুরবানি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার তাকওয়া ও সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনে (১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত) নির্দিষ্ট পশু জবেহ করা।

কুরবানি ইসলামি শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরতের পর প্রতি বছর কুরবানি করেছেন। তিনি কখনও কুরবানি পরিত্যাগ করেননি; বরং কুরবানি পরিত্যাগকারীদের ওপর অভিসম্পাত করেছেন।

আরও পড়ুন- শিক্ষামূলক উক্তি | বিখ্যাত মনীষীদের বিখ্যাত উক্তি

কুরবানি সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের বিধানঃ-

প্রথমেই বলে নিচ্ছি, অনেক ওলামায়ে কেরাম মনে করেন কুরবানি ওয়াজিব নয় বরং সুন্নতে ‍মুয়াক্কাদা। আবার অনেকে মনে করে থাকে কুরবানি আদায় করা ওয়াজিব। তবে, আজকে আমরা বিতর্কিত বিষয় উল্লেখ করবো না। যেহেতু এটি আদায় করা সম্পর্কে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) নির্দেশ প্রদান করেছেন আমরা সেদিকেই অগ্রসর হবো।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

অর্থঃ- ‘’হে রাসুল! আপনি বলুন, আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য নিবেদিত।’’ (সুরাহ- আনআম, আয়াতঃ ১৬২)

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ – فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

অর্থঃ- ‘’নিশ্চয় আমি আপনাকে কাওসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানি করুন।’’ (সুরাহ- কাউসার, আয়াতঃ ১-২)

অপরদিকে হাদীস শরিফে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ’’যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও কুরবানি করল না, সে যেনো আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নংঃ ২১২৩, মুসনাদে আহমদ, হাদিস নংঃ ৮২৭৩)

আরও পড়ুন- অল্প বয়সে বিয়ে করার উপকারিতা

কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্তঃ-

সকল মুসলিমদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়। কুরবানি ওয়াজিব হবার জন্য কতিপয় শর্ত রয়েছে। কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সমূহ হলো-

১. মুসলিম হওয়াঃ- অতএব অমুসলিমদের ওপর কুরবানির বিধান প্রযোজ্য হবে না। কুরবানি আদায় করার জন্য অবশ্যই মুসলিম হতে হবে।

২. প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়াঃ- অতএব অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক ব্যক্তি নির্দিষ্ট সম্পদের মালিক হলেও তার ওপর কুরবানি আদায় করা আবশ্যক নয়।

৩. সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়াঃ- অতএব কোনো পাগল বা অসুস্থ ব্যাক্তি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।

৪. স্বাধীন হওয়াঃ- অতএব কোনো পরাধীন বা দাস-দাসীর ওপর কুরবানি আদায় করা আবশ্যক নয়।

৫. মুকিম হওয়াঃ- অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি মুসাফির হয়ে থাকে তাহলে তার ওপর কুরবানি আবশ্যক নয়। যদি কোনো ব্যক্তি নিজ বাসস্থান থেকে কমপক্ষে ৪৮ মাইল (৭৭.২৩২ কিলোমিটার) রাস্তা অতিক্রম করে কোন স্থানে ভ্রমণ করেন তবেই তাকে মুসাফির বলা যাবে। মুকিম হতে হলে কোনো স্থানে ১৫ দিনের বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হতে হবে।

৬. নিসাব পরিমাণ মালিক হওয়াঃ- অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া কিংবা যার ওপর যাকাত ফরজ হয়েছে। ১০ জিলহজ ফজরের পর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাকে কুরবানি আদায় করতে হবে। কুরবানির ওয়াজিব হওয়ার জন্য ওই সম্পদ এক বছর অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (আদ দুররুল মুখতার, পৃষ্ঠাঃ ২১৯, খণ্ডঃ ০৫)

আরও পড়ুন- ঈদের নামাজের নিয়ম ও প্রয়োজনীয় মাসয়ালা

কতটুকু সম্পদের মালিক হলে কুরবানি ওয়াজিব হবে?

কুরবানি ওয়াজিব হবার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। আর নিসাব পরিমাণ সম্পদ বলতে যদি কারো নিকট সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা থাকে অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব সম্পদ মিলে সাড়ে ৫২ ভরি রুপার সমমূল্যের হয়, তখনও কুরবানি করা ওয়াজিব।

সরাসরি স্বর্ণ বা রুপা থাকা শর্ত নয়, বরং কোনো ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যমান থাকা নগদ অর্থ, বাড়ি বা ব্যবসায়িক পণ্য বা অন্যান্য আসবাবপত্রের মূল্য যদি সাড়ে ৭ তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে ৫২ ভরি রুপ্যের মূল্যের সমান হয় তাহলে তাহার উপর কুরবানি আবশ্যক। (তাবয়িনুল হাকায়িক, পৃষ্ঠাঃ ১০, খণ্ডঃ ৬)

আরও পড়ুন- কুরআন শরীফের ১১৪ টি সূরার নাম বাংলা অর্থসহ

কুরবানির গুরুত্বপূর্ণ মাসআলাঃ-

১. মোট তিন দিন কুরবানি করা যায়। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০তারিখে কুরবানি করা উত্তম। (বাদায়েউস সানায়ে ৫/৮০, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫, আল ইখতিয়ার ৫/১৯, মোবাইল শামেলা থেকে গৃহীত)

২. যে সমস্ত এলাকার লোকের উপরে জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানি করা বৈধ নয়।

হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে হযরত আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবী (স.) বলেছেন, ’’যে ব্যক্তি সালাত আদায়ের পুর্বে কুরবানি করলো সে নিজের জন্যই জবেহ করলো। আর যে ব্যক্তি সালাত আদায়ের পরে কুরবানি করলো, তার কুরবানী পূর্ণ হলো এবং সে মুসলিমদের নীতি গ্রহণ করল। (আধুনিক প্রকাশনী- ৫১৩৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫০৩৫, সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৫৪৬, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৫, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫)

৩. কোন নাবালেগ সন্তান যদি নেসাব পরিমান সম্পদের মালিক হয় এবং এই তিন দিনের মধ্যে সে প্রাপ্তবয়স্ক হয় তাহলে তার উপর কুরবানি করা ওয়াজিব।

৪. যে সমস্ত ব্যক্তিরা মাঝে মাঝে পাগল হয়ে যায় আবার সুস্থ হয়ে যায় এসকল ব্যক্তিরা যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় এবং উক্ত তিন দিন সুস্থ থাকে তাহলে তাদের উপরে কুরবানি করা ওয়াজিব।

৫. একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে অর্থাৎ তাদের প্রত্যেকের কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে প্রত্যেকের উপর ভিন্ন ভিন্ন কুরবানি ওয়াজিব।

পরিবারের যত সদস্যের উপর কুরবানি ওয়াজিব তাদের প্রত্যেকেই একটি করে পশু কুরবানি করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কুরবানির সকলের জন্য যথেষ্ট হবে না। (আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৩ ,ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৭/৩১২)

৬. যে ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব তিনি নিজের পক্ষ থেকে কুরবানি আদায় করবেন অতঃপর সম্ভব হলে জিবীত বা মৃত পিতা-মাতা বা অন্যান্যদের পক্ষ থেকে কুরবানি আদায় করতে পারেন। এক্ষেত্রে নিজের ওয়াজিব কুরবানি না করে অন্যান্যদের পক্ষ থেকে যেমন মৃত পিতা-মাতা বা অন্যান্য ব্যক্তির কুরবানি আদায় করা সঠিক হবে না। (ফাতায়ায় মাহমুদিয়া ১৭/৩১২)

৭. যে ব্যক্তির উপর কুরবানি ওয়াজিব এমন ব্যক্তি যদি কুরবানির তিন দিনের যেকোনো একদিনেও কুরবানি না করে পশু বা তার মূল্য সদকা করে দেয় তাহলে কুরবানি আদায় হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৬ ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ১৭/৩০৯)

৮. কোন ব্যক্তি যদি কুরবানীর উদ্দেশ্যে পশু ক্রয় করে অতঃপর কুরবানী করার পূর্বেই তা হারিয়ে যায়, বা মারা যায়, কিংবা চুরি হয়ে যায় তাহলে তার জন্য আবশ্যক হলো অন্য একটি পশু কুরবানি করা। (বাদায়েউস সানায়ে ৫/৬৬।কাযীখান ৩/৩৪৪আদ্দুররুল মুহতার ৬/৩১৫ ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/২৯৫)

আরও পড়ুন- ঈদের নামাজের নিয়ম ও গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা

আরও পড়ুন- ঔষধ ছাড়া স্বাস্থ্য ভাল রাখার ২০টি কার্যকরী উপায়

শেষ কথাঃ- প্রিয় পাঠক, বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসআলা উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। যদি উপরের কোনো বিধান বা মাসআলাতে কোনো পরিমাণ ভুল বা সন্দেহ মনে হয় তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে জানানোর চেষ্টা করবেন।

’’কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত’’ আর্টিকেলটির মাধ্যমে উপকৃত হয়ে থাকলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন। সবসময় সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদে ভালো থাকবেন। আমাদের আরও অন্যান্য পোষ্টগুলো ভাল লাগলে অবশ্যই পড়তে পারেন। পরবতীর্তে আমাদের ওয়েবসাইটে আসার অনুরোধ করছি। আজ এই পর্যন্তই

———– ধন্যবাদ! ———–

About Bondhu24

Check Also

বিয়ে করার উপকারিতা

অল্প বয়সে বিয়ে করার উপকারিতা ইসলাম ও বাস্তবতার আলোকে

বিয়ের সঠিক বয়স কত? এবং অল্প বয়সে বিয়ে করার উপকারিতা বা কি কি ক্ষতির সম্ভাবনা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *